
তার পিতা মরহুম মৌলভী মোসলেম গাজী। ১৯৫০ সাল মাতা রহিমা খাতুনের গর্ভে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ তার। সাত ভাইবোনের তিনি চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন। পড়ালেখার হাতে খড়ি গ্রামের মক্তবেই। বাল্যকালে পরিবার থেকেই ইসলামের আহকাম হুকুম মেনে চলার দীক্ষা পান। মক্তবে পড়ালেখাকালীন শিক্ষকদের কাছে নিজস্ব মেধা ও স্বকীয়তার কারণে অল্প দিনেই তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী বলে পরিগণিত হন আবদুল হামিদ। প্রাজ্ঞ এ আলেম প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাহমুদপুর আমিনিয়া কামিল মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে দাখিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে আগরদাড়ি আমিনিয়া কামিল মাদরাসা থেকে ফাজিল এবং ১৯৭১ সালে হাদীসের ওপরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কামিল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন।
বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ১৯৭২ সালে শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন সাতক্ষীরার মাহমুদপুর আমিনিয়া কামিল মাদরাসায়। তবে মাত্র কিছুদিন পরেই দেবহাটা উপজেলার হাদীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী মৌলভী পদে যোগদান করেন।
১৯৭৪ সালে এলাকার বিশিষ্ট দানবীর আলহাজ্ব আব্দুর রহমান সাহেবের সহযোগিতায় নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহিী নওয়াপাড়া সিদ্দিকীয় সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অত্যন্ত সুনামের সাথে ৩৪ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসর গ্রহণ করেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ নিজের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শকে কোনো শক্তির কাছে সমর্পণ করেননি। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার দীপ্ত সহস নিয়ে চলতেন সবসময়। সাতক্ষীরার ইসলামী আন্দোলনের বীজ বপণের রুপকার ছিলেন সাতক্ষীরার গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন সাবেক এমপি মরহুম কাজী সামছুর রহমান তিনি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। বাইসাইকেলে করে দুই বন্ধু সাতক্ষীরার প্রতিটি প্রান্তরে ছুটে গেছেন ইসলামী আন্দোলনের সুমহান আদর্শের পরশ নিয়ে। বিপথগামী মানুষকে ফিরিয়ে এনেছেন নতুন আলোয় উদ্ধাসিত করে।
এজন্য মাওলানার অপর নেমে আসে সরকারের দমন-পীড়ন। বরেণ্য এই শিক্ষবিদকে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির পথ বেছে নেয়। কারাবরণ করতে হয় তাকে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও নতুন মামলায় আবার গ্রেফতারে আটকে রাখে তাঁকে। তবে জুলুম-নির্যাতনে তিনি কখনই ভেঙে পড়েননি। সব কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে অন্যের কষ্টের ভাগিদার হয়েছিলেন তিনি। জেল খানার চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকা অবস্থায় নিজ প্রচেষ্টায় হিফজ করেন মহাগ্রন্থ আল কোরআন।
মাওলানা আবদুল হামিদ উল্লেখ করেন, মৌখিক দৈহিক ও আর্থিক শোকর প্রাণপণ ভাবেই যতই আদায় করা হোক না কেন? মনে করতে হবে এক একটা নেয়ামতের যে শোকর আদায় করা দরকার তা আদৌ করা হয় নাই। সবসময় নিজকে আমিত্ব বা অহংকার মুক্ত করে বিনয়ের সাথে আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী হতে হবে। রাতের শেষাংশে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে সেজদাহ অবনত হয়ে কান্নাকাটি করে বলতে হবে, হে দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ’ বিশাল আসমান ও জমিনের মালিক শুধু নও আসমানের ওপরে এর মাঝখানে ও জমিনের নিচে যা কিছু আছে তুমি এর খালেক স্রষ্টা ও মালিক। আমি তোমার এক অধম গোলাম, তোমার নেয়ামতে আমি সার্বক্ষণিক ডুবে আছি। যেভাবে তোমার শোকর আদায় করা দরকার তা আমি করতে পারিনি, আমাকে তুমি অন্ধ খোড়া পঙ্গু কওে সৃষ্টি করলে আমার কিছু করার থাকতো না। অতএব শোকর বা কৃতজ্ঞতা একমাত্র আল্লাহর পাওয়া। যদি অসংখ্য নেয়মত উপভোগ করে তারই ােকর না করি, তাহলে তার প্রতি কুফুরি করা হবে।
বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হামিদ শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি মানুষের মাঝে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌছানোর জন্য লিখে যান কিছু পান্ডুলিপি। তার লেখা বইগুলো হচ্ছে নামাজ রাজনীতির প্রশিক্ষণ, ‘শুকুরিয়া কাকে করব, কেন করব, কিভাবে করব’ যা বর্তমানে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ গ্রন্থে মহান আল্লাহর শুকরিয়া করার জন্য একজন বান্দার কেন প্রয়োজন সে বিষয়টি অত্যন্ত যুক্তির সাথে উপস্থাপন করেছেন।
৬ কন্যা ও ১ পুত্রসন্তানের জনক এই মানুষটি ছয় কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন সাতক্ষীরার ৬ জন খ্যাতিমান আলেমের সাথে। একমাত্র পুত্র মাওলানা হাবিবুল্লাহ পিতার আদর্শকে আগলে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার রেখে যাওয়া স্মৃতি, নাম পরম মমতায় আগলে রেখে চলছেন শুভানুধ্যায়ীরা। হয়তো এই ধারাবাহিকতা চলবে হয়তো প্রজন্মে প্রজন্মে।
তেজোদীপ্ত নেতৃত্বের অধিকারী এই মানুষটি ইসলামী আন্দোলনের আদর্শিক সু-ঘ্রান মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লড়াইয়েও ছিলেন এক অকুতোভয় সৈনিক। যার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে মজলুম জনপদ সাতক্ষীরার অগণিত ইসলাম প্রিয় তাওহিদী জনতা। শুধু পরিবার নয় সমাজের চোখেও একজন আদর্শ অভিভাবক।
পরিশেষে বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হামিদের দেশ-বিদেশের অগণন ভক্ত অনুরাগীদের কাছে আমার বিনম্র শ্রদ্ধায় আবেদন, তার অপূর্ণ থাকা আদর্শিক লড়াইকে সুনীল দিগন্তে উদ্ভাসিত করার প্রত্যয়ে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ইসলামের সুমহান দাওয়াতের সৌরভ ছড়িয়ে দেওয়ার দিপ্ত মানসে ঐক্যবদ্ধ চিত্তে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই মৃত্যুঞ্জয়ী কিংবদন্তি এই মানুষটির প্রতি ভালবাসার যথার্থতা ফুটে উঠবে। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতী মেহমান হিসেবে গ্রহন করবেন- এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব ও চেয়ারম্যান-রিভারসাইড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, বাংলাদেশ।
0 coment rios: