শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০

করোনায় মৃতের গোসল কি বলে আইডিসিআর ও ইসলাম


আইইডিসিআর

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দেশে ইতোমধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় মৃতের গোসলের সময় ভাইরাসটির সংক্রমণের সম্ভাবনা কতটা তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল। সে বিষয়টিই আজ স্পষ্ট করলো সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। বলা হয়, মৃতের গোসলের সময় সংক্রমণের আশঙ্কা তো অবশ্যই আছে, তবে এক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনেই প্রক্রিয়াটি (গোসল) সম্পন্ন করা হয়। সুতরা এ বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, সেখান থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।’
মীরাজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘যদি কারো এ ধরনের আশঙ্কা থাকে- সেক্ষেত্রে তিনি যতি আক্রান্ত নাও হয়ে থাকেন তার পরও তার বা তাদের পরীক্ষা করা হবে।’
এ ধরনের কোনো দুশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মৃত কোনো ব্যক্তি থেকে ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়েছে- এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। সুতরাং এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার অনুরোধও করেন আইইডিসিআরের পরিচালক।
তিনি জানান, নিশ্চিতভাবে করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, আইইডিসিআরের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয়ে তাদের গোসল ও দাফনকার্য পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা সিটি করপোরেশনও তাদের সহযোগিতা করছে।
সেব্রিনা ফ্লোরা আরো জানান, পুরো প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে- যাতে কোনোভাবেই সংক্রমণ ছড়াতে না পারে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে আরো ৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ৪৪ জন করোনা রোগী ছিল। নতুন চারজন আক্রান্ত হওয়ায় দেশে মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৮ জনে।  
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। বুধবার পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে দেশে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। গত দুই দিনে দেশে নতুন কেউ মারা যায়নি। এ পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে মোট ১১ জন সুস্থ হয়েছেন।
ইসলামী হুকুমাত
সাধারণত কোনো মুসলমান মারা গেলে উপস্থিত মুসলিমদের ওপর ওই মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন করা ফরজে কেফায়া। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কেউ যদি মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তবে ইসলামের বিধান বা মূলনীতি কী হবে?
বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ওই ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, জানাজা দেয়া এবং দাফন করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি কী?
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার গোসল, জানাজা ও দাফনে সংক্রমণ হয়ে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির গোসল দেয়া, জানাজা ও দাফনের মূলনীতি হলো-
হাদিসে মহামারিতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হলে সেও শহীদি মর্যাদা লাভ করবে। আর এ ব্যক্তিকে শহীদ হিসেবে মনে করে গোসল, জানাজা না দিয়েই দাফন করা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ আলেমরা। অনেক ওলামায়ে কেরাম বলেছেন-
ড. আব্দুল হাদি যারের ফতোয়া
আল ওয়াত্বান অনলাইন গণমাধ্যমে মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বোর্ডের প্রধান এবং সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য ড. আব্দুল হাদি যারে, তার একটি ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে যে-
`করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অথবা এ জাতীয় কোনো অসুস্থতা বা রোগ-বালাই; যা ছড়িয়ে পড়তে পারে এ রকম আশংকা যদি থাকে এবং গোসল করানোর কোনো ব্যবস্থাই যদি না থাকে অর্থাৎ সতকর্তামূলকভাবেও যদি গোসল করানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকে বা করতে গেলেই সমাজের অন্য মানুষের জন্য যদি তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে ‘তায়াম্মুম’।
আর তায়াম্মুম হলো কোনো ব্যক্তি তার হাত মাটিতে ফেলে সে হাত মৃত ব্যক্তির মুখ মাসেহ করে দেবে, হাত মাসেহ করে দেবে। এভাবে মৃত ব্যক্তিকে বিদায় জানাবে এবং দাফনের ব্যবস্থা করবে।
আর যদি তায়াম্মুমটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এবং কোনোভাবেই তায়াম্মুম করানো না যায় তাহলে সেক্ষেত্রে এ ব্যক্তিকে গোসল এবং তায়াম্মুম ছাড়াও যদি দাফন করা হয় তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন-
‘অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শুন, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম। (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১৬)
তিনি এ আয়াত থেকে মত ব্যক্ত করেছেন যে, মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেলে অন্যদের ক্ষতি নিশ্চিত হয়ে গেলে সে কাজ না করলে কোনো গোনাহগার হবো না।
শায়খ আহমদ মামদুহ-এর ফতোয়া
একই মত ব্যক্ত করেছেন, দারুল ইফতাহ আল মাসরিয়ার আমির শায়খ আহমদ মামদুহ এক ভিডিও বার্তা উল্লেখ করেছেন, গোসল করানোর চেষ্টা করতে হবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে গোসল করাতে পানি স্প্রে করার মাধ্যমে তার শরীর ধুয়ে দেয়া যায় তাতেই চলবে। এ চেষ্টা করতে হবে। নতুবা তায়াম্মুম করাবে। একান্তই না পারলে কোনো অসুবিধা হবে না।
শেখ আব্দুল হামিদ আল-আতরাশ-এর ফতোয়া
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগের সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হামিদ আল-আতরাশ কিছুটা ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন বিনা অজুহাতে কোনো মুসলমানকে গোসল দেয়া ছাড়া বিদায়/দাফন দেয়া জায়েজ হবে না। নিয়ম মোতাবেক অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তার গোসল ও জানাজা দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, মৃতু্যর আগে জীবিত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে যে সতর্কতায় চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তার মৃতু্যর পরে সেই সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার গোসল ও জানাজা দেয়া যেতে পারে। আর যদি মৃতু্যর পর গোসল ও জানাজা দেয়া ক্ষতিকর বলে জানা যায় এবং তায়াম্মুম ও ক্ষতির হবে বলে চিকিৎসকরা জানান তবে গোসল ও তায়াম্মুম ছাড়াই দাফন দেয়া যাবে। এতে কেউ গোনাহগার হবে না।
সুতরাং যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন যে, করোনা বা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কারণে ওই মৃত ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাস রয়েছে এবং তার কাছাকাছি গেলে, তার গোসল দিলে কিংবা তার জানাজা দিলে অন্য সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে বা প্রাণনাশের আশংকা রয়েছে তবে সে ক্ষেত্রে গোসল, জানাজা স্থগিত হতে পারে।
ইসলামের মূলনীতি
মহামারি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য কোনো সামাজিক কিংবা ধর্মীয় জনসমাগমে যাওয়া যেমন বৈধ নয়, তেমনি অন্য মুসলমানের ক্ষতি বা কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন দেয়া ছাড়া দাফনেও কোনো বাধা নেই। কেননা, মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো-
>> ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৫৮)
>> لا ضرر ولا ضرار
(নিজে) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও (অন্যকে) ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো অবকাশ নেই।
>> 
أن الضرر يدفع قدر الإمكان
যতটা সম্ভব ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিহত করতে হবে।
>> কষ্টকর বিধান সহজ বিধানকে আকর্ষণ করে।
>> ওজরের কারণে।
এছাড়া আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর কষ্টকর কোনো বিধান চাপিয়ে দেন না বলেও কুরআনে উল্লেখ করেন-
‘ আল্লাহ তাআলা কারো ওপর তার ক্ষমতার বাইরে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সুরাবাকারা : আয়াত ২৮৬)
‘ আল্লাহ তাআলা চান তোমাদের বোঝা হালকা করে দিতে এবং মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৭)
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উল্লেখিত মূলনীতির আলোকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা চিন্তা করেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির গোসল ও জানাজা ছাড়াই দাফন করা যাবে বলেছেন ওলামায়ে কেরাম। আবার মৃত ব্যক্তিকে তায়াম্মুম দিয়ে, লাশ ছাড়াই গায়েবানা জানাজা দেয়া যাবে বলেছেন অনেকে।
সংগৃহীত


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: